রোজা ভঙ্গের বৈধ কারণসমূহ: শরিয়তের নির্দেশনা

ইসলামে রমজানের রোজা পালন প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য ফরজ। তবে, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শরিয়ত রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি প্রদান করেছে। নিম্নে আমরা সেই কারণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

শরিয়ত রোজা ভঙ্গের প্রতিবিধান রাখলেও তার শতভাগ ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (শরিয়ত অনুমোদিত) কোনো কারণ ছাড়া বা রোগ ছাড়া রমজান মাসের একটি রোজা ভেঙে ফেলে, তার পুরো জীবনের রোজা দিয়েও এর ক্ষতিপূরণ হবে না; যদিও সে জীবনভর রোজা রাখে।’

(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭২৩)

১. অসুস্থতা বা শারীরিক অক্ষমতা

যে ব্যক্তি এমন অসুস্থতায় আক্রান্ত, যা রোজা রাখলে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে বা সুস্থ হতে বিলম্ব হয়, সে ক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গ করা বা রোজা না রাখা বৈধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে, অন্য দিনে সে সংখ্যা পূরণ করবে।”

২. সফর বা যাত্রা

যারা রমজান মাসে দীর্ঘ সফরে থাকেন, তাদের জন্য রোজা ভঙ্গ করার অনুমতি রয়েছে। তবে, যদি সফর রোজা পালনে অসুবিধা সৃষ্টি না করে, তাহলে রোজা রাখা উত্তম।

৩. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী

গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী নারীরা যদি আশঙ্কা করেন যে রোজা রাখা তাদের স্বাস্থ্যের বা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাহলে তারা রোজা ভঙ্গ করতে পারেন। পরে সুবিধাজনক সময়ে সেই রোজাগুলো কাজা করতে হবে।

৪. প্রবীণ ও দুর্বল ব্যক্তি

যেসব প্রবীণ ব্যক্তি রোজা পালনে সক্ষম নন এবং ভবিষ্যতেও সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তারা রোজা ভঙ্গ করতে পারেন। তাদের জন্য প্রতিটি রোজার বদলে ফিদিয়া প্রদান করতে হবে।

৫. কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ

যদি কেউ এমন কাজে নিয়োজিত থাকে যা রোজা রাখার কারণে তার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাহলে সে রোজা ভঙ্গ করতে পারে। পরে সেই রোজাগুলো কাজা করতে হবে।

৬. মাসিক বা প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব

নারীদের মাসিক বা প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাবের সময় রোজা রাখা নিষিদ্ধ। এই সময়ে তারা রোজা ভঙ্গ করবেন এবং পরে সেই রোজাগুলো কাজা করবেন।

৭. বাধ্যতামূলক খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ

কিছু পরিস্থিতিতে, যেমন জীবন রক্ষার্থে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করা আবশ্যক হলে, রোজা ভঙ্গ করা বৈধ। পরে সেই রোজাগুলো কাজা করতে হবে।

পবিত্র কোরআনে রোজা ভঙ্গের কারণ

রোজা অবশ্যপালনীয় বিধান এবং তা ভঙ্গ হওয়ার বিষয়ে কোরআনের ঘোষণা হলো, ‘রোজার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ।আল্লাহ জানেন যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সঙ্গে সংগত হও এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা করো। আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ রাতের কৃষ্ণরেখা থেকে উষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়।অতঃপর রাত আসা পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’

(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৭)

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ রোজাদারকে তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেছেন—স্ত্রী সম্ভোগ, খাবার গ্রহণ এবং পানীয় গ্রহণ। সুতরাং কেউ স্ত্রী সম্ভোগ ও পানাহারে লিপ্ত হলে তার রোজা ভেঙে যাবে। এ ছাড়া আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে হায়েজ বা নারীদের ঋতুস্রাবের কারণেও রোজা ভেঙে যায়।

রোজা ভঙ্গের প্রতিবিধান

রোজা ভঙ্গের কারণ এবং তাদের প্রতিকার রোজা ভঙ্গের কারণগুলো সাধারণত দুটি ভাগে বিভক্ত:

১. রোজা ভঙ্গ এবং কাজা ও কাফফারা উভয়ই প্রযোজ্য

এই ধরনের ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হলো ইচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রী সহবাস এবং খাবার বা পানীয় গ্রহণ। যদি কেউ রমজানের দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে স্ত্রী সহবাস করেন বা খাবার-পানীয় গ্রহণ করেন, তবে তার রোজা বাতিল হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাজা রোজা এবং কাফফারা উভয়ই পালন করতে হবে। তবে ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ (রহ.) এর মতে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খেলে শুধু কাজা করতে হবে; কাফফারা দিতে হবে না। তাদের মতে, শুধুমাত্র স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে কাফফারা ওয়াজিব হয়।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ওষুধ ও ধূমপান পানাহারের অন্তর্ভুক্ত এবং যেকোনো স্বেচ্ছাচারী বীর্যপাত স্ত্রী সহবাসের অন্তর্ভুক্ত। যদি কোনো স্বামী জোর করে স্ত্রীকে সহবাসে বাধ্য করে, তবে স্ত্রী শুধু কাজা রোজা পালন করবে আর স্বামীকে কাজা ও কাফফারা উভয়ই পালন করতে হবে।

২. রোজা ভঙ্গের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাজা প্রযোজ্য

এমন কিছু কারণ যেখানে রোজা ভঙ্গ হলে শুধুমাত্র কাজা করতে হবে, কাফফারা দিতে হবে না। সেগুলো হলো:

  • ১. ইচ্ছা করে বমি করলে,
  • ২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেললে,
  • ৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব হলে,
  • ৪. ইসলাম ত্যাগ করলে,
  • ৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা স্যালাইন দিলে,
  • ৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে,
  • ৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে,
  • ৮. রোজাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে,
  • ৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে,
  • ১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে,
  • ১১. মুখ ভরে বমি করলে,
  • ১২. ভুলবশত কোনো কিছু খেয়ে রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে,
  • ১৩. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে,
  • ১৪. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে,
  • ১৫. জিহ্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে,
  • ১৬. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে,
  • ১৭. রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় অজুতে কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার সময় ভেতরে পানি চলে গেলে।

রোজার কাজা ও কাফফারা কী

রোজার কাজা হলো ভেঙে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা রোজার প্রতিবিধান হিসেবে শুধু রোজা আদায় করা; অতিরিক্ত কিছু আদায় না করা। অন্যদিকে রোজার কাফফারা হলো প্রতিবিধান হিসেবে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা। রোজার কাফফারা বিষয়ে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার কী হয়েছে? সে বলল, আমি রোজা অবস্থায় আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, স্বাধীন করার মতো কোনো ক্রীতদাস তুমি মুক্ত করতে পারবে কি? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি একাধারে দুই মাস সাওম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। এরপর তিনি বললেন, ৬০ জন মিসকিন খাওয়াতে পারবে কি? সে বলল, না। হাদিস বর্ণনাকারী বলেন, তখন নবী (সা.) থেমে গেলেন, আমরাও এ অবস্থায় ছিলাম। এ সময় নবী (সা.)-এর কাছে এক আরাক পেশ করা হলো, যাতে খেজুর ছিল। আরাক হলো ঝুড়ি। নবী (সা.) বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি। তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে দান করে দাও। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার চেয়েও বেশি অভাবগ্রস্তকে সদকা করব? আল্লাহর শপথ, মদিনার উভয় প্রান্তের মধ্যে আমার পরিবারের চেয়ে অভাবগ্রস্ত কেউ নেই। রাসুল (সা.) হেসে উঠলেন এবং তাঁর দাঁত দেখা গেল। অতঃপর তিনি বললেন, এগুলো তোমার পরিবারকে খাওয়াও।

(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৩৬)

বেশির ভাগ ফকিহ বলেন, হাদিসে বর্ণিত ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আবশ্যক। অর্থাৎ রোজা ভঙ্গকারী দাস মুক্ত করতে অক্ষম হলে দুই মাস রোজা রাখবে। আর দুই মাস রোজা রাখতে ব্যর্থ হলে ৬০ জন মিসকিনকে খাবার খাওয়াবে।

BD JOB PORTAL

Leave a Reply